মানুষ কেন ধর্ষণ করে; যা বললেন এই শিক্ষার্থী

মানুষ কেন ধর্ষণ করে; যা বললেন এই শিক্ষার্থী

Brand Bazaar

গত তিন বছর ধরে ভারতে শতাধিক অপরাধী প্রমাণিত ধর্ষকের সাক্ষাৎকার নিয়েছেন মধুমিতা পান্ডে। ২০১৩ সালে ২২ বছর বয়সে তিহার জেলে এক ধর্ষকের সাক্ষাৎকারে মাধ্যমে এ যাত্রা শুরু করেন তিনি। প্রথম সাক্ষাৎকারটি অনেকটা শৌখিনভাবে করলেও পরে বিশ্ববিদ্যালয়ের থিসিসের প্রয়োজনে তিনি ধারাবাহিকভাবে ভারতে ধর্ষকদের সাক্ষাৎকার নিতে শুরু করেন।

মানুষ কেন ধর্ষণ করে; যা বললেন এই শিক্ষার্থী

কেন একজন মানুষ ধর্ষকামী হয়ে ওঠে, ধর্ষকদের সাথে কথা বলে তা জানার ও বোঝার চেষ্টা করেছেন তিনি।
২০১৩ সালে মধুমিতা পান্ডে যখন এ কাজ শুরু করেন তখন ‘নির্ভয়া’র মৃত্যুকে ঘিরে সারা ভারতে উত্তাল পরিস্থিতি বিরাজ করছে।

 

মেডিকেলের ছাত্রী ‘নির্ভয়া’ (ভারতীয় সংবাদমাধ্যম তখন ওই তরুণীকে এ নামটি দেয়, যার অর্থ ভয়ডরহীন) রাতে তার বন্ধুর সাথে বাড়ি ফেরার সময় চলন্ত বাসে সংঘবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হয়।

 

ওই ঘটনা সাধারণ মানুষের বিবেককে নাড়া দেয়, প্রতিবাদে রাস্তায় নেমে আসেন লাখো মানুষ। মধুমিতা তখন লন্ডনে মাস্টার্স শেষ করছেন।

 

নির্ভয়ার ঘটনায় ভারতজুড়ে আলোড়নের পর মধুমিতার মনে প্রশ্ন আসে, ‘মানুষ কেন ধর্ষণ করে, কী কারণে সে ধর্ষণে প্ররোচিত হয়?’ এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে বের হন তিনি। প্রথমেই তিনি তিহার জেলে নির্ভয়ার একজন ধর্ষকের সাথে কথা বলেন।

 

তিনি দেখেছেন, ধর্ষকের অধিকাংশই একেবারে অশিক্ষিত। অল্প কয়েকজন মাত্র হাইস্কুলের গন্ডি পার হতে পেরেছিলেন।

 

অনেকেই ছিলেন যারা তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণিতেই পড়াশোনা বন্ধ করে দিয়েছেন। মধুমিতা বলেন, ‘আমি যখন তাদের সাক্ষাৎকার নিতে যেতাম, তখন আগে থেকেই জানতাম তারা কী ভয়ঙ্কর অপরাধী।

 

কিন্তু আপনি যখন তাদের সাথে কথা বলবেন, তখন আপনার মনেই হবে না তারা অন্য মানুষদের চেয়ে আলাদা। তারা আর সবার মতোই মানুষ। কিন্তু চিন্তার বৈকল্য ও শিক্ষার অভাবেই তারা ধর্ষণের মতো কাণ্ড ঘটিয়েছে।’

 

ভারতীয় সমাজে এমনকি শিক্ষিত ভারতীয় সমাজেও নারীদের গতানুগতিক ঘরের কাজ করতে দেখা যায়। অনেক নারী তাদের স্বামীদের নাম পর্যন্ত উচ্চারণ করে না। তারা স্বামীদের ডাকে ‘শুনছ’ ‘এই যে শুনছ’ কিংবা ‘সুমনের বাবা’ এমন নামে।

 

পান্ডে বলেন, ‘ভারতীয় সমাজে পুরুষরা পৌরষতন্ত্রের ভুল ধারণা নিয়ে বড় হয় আর নারীরাও অধস্তন হতে হতে অভ্যস্ত। অনেকে মনে করেন যে ধর্ষকদের মধ্যে উত্তরাধিকারগত কোনো সমস্যা থাকতে পারে। কিন্তু তারা তো আমাদের সমাজের অংশ। আমাদের সমাজেই তারা জন্ম নিয়েছে, বেড়ে উঠছে। আমরা তো তাদেরকে ভিন্ন গ্রহণ থেকে ধরে আনছি না।’

ধর্ষকদের অনেক চিন্তা ভাবনা তারা তাদের পরিবার থেকে পেয়েছে বলে মনে হয়েছে মধুমিতা পান্ডের, যেসব ধ্যান ধারণা ভারতীয় সমাজে এখনও বিদ্যমান। তাদের সাথে কথা বলার সময় এক ভিন্ন অভিজ্ঞতার কথা বর্ণনা করেন পান্ডে। তিনি বলেন, ‘আপনি যখন তাদের সাথে কথা বলবেন, আপনি অবাক হয়ে যাবেন।

তারা এমনভাবে কথা বলবে যাতে আপনার মনে তাদের জন্য মায়া জন্ম নেয় এবং তাদের বর্তমান অবস্থার জন্য আপনার দুঃখবোধ হয়। আমি একজন নারী। নারী হিসেবে ধর্ষণের কারণে একজন নারী শারীরিক ও মানসিকভাবে কতটা বিপর্যস্ত হয়, তা আমি কিছুটা হলেও বুঝতে পারি।

কিন্তু তাদের সাথে কথা বলার এক পর্যায়ে আমি ভুলতেই বসেছিলাম যে এরা ধর্ষণের মতো জঘন্য একটা অপরাধ সংঘটিত করেছে। আমি বহু ধর্ষকের সাথে কথা বলেছি। তাদের মনোজগতটা বোঝার চেষ্টা করেছি। আমার অভিজ্ঞতায় আমি দেখেছি যে অধিকাংশ ধর্ষকই ধর্ষণের আগে জানতই না যে ব্যাপারটা ধর্ষণ এবং এটি একটি মারাত্মক অপরাধ। এর পরিণতি সম্পর্কেও তাদের কোনো ধারণা ছিল না।’

ভারতের সমাজব্যবস্থা এখনও অনেক রক্ষণশীল। যৌন শিক্ষা এখনও এখানে একটা ট্যাবু হয়েই আছে। অধিকাংশ স্কুলের কারিকুলামেই যৌন শিক্ষার বিষয়টা অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। আইনপ্রণেতাদের দাবি, স্কুলে এসব শেখানো হলে বাচ্চাদের ‘ক্ষতি’ হবে ও এটি ভারতীয় মূল্যবোধের বিপক্ষে যাবে। পান্ডের প্রশ্ন, যেখানে পিতামাতা পর্যন্ত সন্তানের সামনে পুরুষ লিঙ্গ, নারীর যোনি, যৌনতা, যৌন শিক্ষার মতো শব্দগুলো উচ্চারণ করতে অস্বস্তি বোধ করেন, অনেক ক্ষেত্রে উচ্চারণই করেন না, সেখানে কীভাবে আপনি শিশু ও কিশোরদের এসব বিষয়ে সচেতন করে তুলবেন?

পান্ডে যেসব ধর্ষকের সাথে কথা বলেছেন, তাদের অধিকাংশই নিজেদের কৃতকর্মকে হালকা করে দেখানোর চেষ্টা করেছেন কিংবা অনেক ক্ষেত্রে নিজেদের নির্দোষও প্রমাণ করার চেষ্টা করেছেন। অনেকে আবার বলছেন ধর্ষণের কোনো ঘটনাই ঘটেনি। মাত্র তিন চারজনকে পেয়েছেন তিনি, যারা তাদের অপরাধ নির্দ্বিধায় স্বীকার করেছেন। বাকী সবাই কোনো না কোনোভাবে তাদের ধর্ষণকাণ্ডকে ‘জায়েজ’ করার চেষ্টা করেছেন।

এরমধ্যে একজনের কথায় যারপরনাই অবাক হয়েছেন মধুমিতা। ওই ধর্ষক মাত্র ৫ বছর বয়সী এক শিশুকন্যাকে ধর্ষণ করেছিল। সে পান্ডেকে বলেছিল, ‘হ্যাঁ, মেয়েটার জন্য আমার খারাপ লাগছে। আমি তার জীবনটা নষ্ট করে ফেলছি। এখন আর সে আর কুমারী নেই। তাকে কেউ বিয়ে করবে না। তবে আমি জেল থেকে ছাড়া পেলে তাকে বিয়ে করতে রাজি আছি।

এই ধর্ষকের কাছে এমন কথা শুনে স্তব্ধ পান্ডে ধর্ষণের শিকার ওই মেয়েটির সাথে দেখা করতে চাইলেন। ওই ধর্ষকও তাকে মেয়েটির ঠিকানা দেয়। যখন পান্ডে তাকে খুঁজে বের করেন, তখন তিনি জানতে পারলেন মেয়েটির অবিভাবকরা জানেও না যে তাদের মেয়ের ধর্ষক জেল খাটছে।

আগামী কয়েক মাসের মধ্যেই মধুমিতা তার গবেষণা প্রকাশ করবেন বলে আশা করছেন। তবে নিজের গবেষণাকাজ নিয়ে বিব্রতকর অবস্থায় পড়তে হচ্ছে বলে জানিয়েছেন তিনি। ‘অনেকে ভাবছেন, এটা নারীবাদী কাজ। তারা ভাবছে নারী হয়ে কীভাবে আমি এমন একটি বিষয় নিয়ে গবেষণা করছি? আমার গবেষণা পুরুষের চিন্তার বিপক্ষে যাবে বলেও আশঙ্কা করছে তারা’, বলেন পান্ডে। সূত্র: ওয়াশিংটন পোস্ট

আপনি আরও পড়তে পারেন

Leave a Comment